রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয়েছে। সোমবার (৫ মে) বিকেলে অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (আমলি কোতোয়ালি) আদালতে মামলাটি করেন আতোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী রোগী।
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল আইন, ২০২০ এর ২৯(১) (২) ধারা মতে অভিযোগকারীর নালিশ আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে আদালতকে অবহিত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন বিজ্ঞ বিচারক মো. রাশেদ হোসাইন। মামলার বাদী মো. আতোয়ার হোসেন (৪৫) গাইবান্ধা সদরের খোলাহাটি কুমারপাড়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে।
তিনি ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং (স্টেন্ট) স্থাপন করে তিনটির টাকা নেওয়াসহ রোগীকে ‘আতঙ্কিত’ করে রিং স্থাপনে উৎসাহিত করার অভিযোগ এনেছেন। চিকিৎসক হিসেবে রিং বিক্রির নিয়ম না থাকলেও ডা. মাহবুবুর রহমান নিজেই রিং বাণিজ্য করেন বলেও মামলার এজাহারে বলা হয়েছে।
আতোয়ার রহমান এজাহারে বলেছেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মাহবুবুর রহমান প্রতারণার মাধ্যমে তার হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং (স্টেন্ট) পরিয়ে তিনটি রিংয়ের টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেছেন। ডা. মাহবুবুর রহমান রিং পরানোর যে সিডি দিয়েছেন তাতে রিং লাগানোর কোনো নজির নেই তবে হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতায় একটা রিং পরানোর রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু ডা. মাহবুবুর তিনটি রিং লাগোনোর কথা বলে আমার কাছ থেকে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন।
আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর হার্ট অ্যাটাক হলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. মাহবুবুর রহমানের অধীনে ভর্তি হন তিনি। এনজিওগ্রাম করে ডা. মাহবুবুর জানান, হার্টের রক্তনালীতে তিনটি ব্লক আছে এজন্য পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। এরপর ৯ শতক জমি বিক্রি করে তিনটি রিংয়ের জন্য মেডিকেলের এমএলএস শহিদুল ইসলামের সহায়তায় তিন লাখ ২০ হাজার টাকায় তিনটি রিং পরাতে রাজি হন ডা. মাহাবুবুর। রিং পরানোর পর অবস্থার উন্নতি না হলে কয়েকদফা ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ডা. মাহাবুবুরের অধীনে। এরপরও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে আতোয়ার গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আরেক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হয়ে সুস্থ হন। এ সময় জানতে পারেন তার হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরানো হয়েছে।
এর আগে, আতোয়ার রহমানসহ আরও বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী ডা. মাহবুবুর রহমানের ‘প্রতারণা ও রিং বাণিজ্যের’ বিরুদ্ধে হাসপাতাল পরিচালক, সিভিল সার্জন, দুদকসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
‘চিকিৎসক হয়ে হার্টের রিং (স্টেন্ট) বিক্রি করেন, হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেন, রক্তনালীতে ব্লক না থাকলেও ব্লক আছে বলে আতঙ্কিত করে তোলেন’- এমন সব অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না হতেই চিকিৎসক মো. মাহবুবুর রহমান বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে অভিযোগ তুলে নিতে ‘চাপ ও হুমকি’ দিচ্ছেন বলে গত ২২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ভুক্তভোগী আতোয়ার রহমান।
ভুক্তভোগী আতোয়ার রহমান এই প্রতিবেদককে জানান, হার্টের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি ওই চিকিৎসকের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বর্তমানে তাকে কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে। মাহবুবুর রহমান আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন লোকজনকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি দেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমি ও আমার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। শেষ পর্যন্ত ন্যাযবিচার পাওয়ার আশায় আদালতের দারস্ত হয়েছি।
এদিকে, ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং বিক্রি ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর ছয়টি লিখিত অভিযোগ হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি অভিযোগ করা হয়েছে দুনীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি, রমেক হাসপাতাল, রংপুর সিভিল সার্জন অফিসে।
সর্বশেষ গত ১০ মার্চ হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ সকল চিকিৎসক একযোগে পরিচালকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেন। ওই চিঠিতে ‘অপচিকিৎসায় দুই রোগীর মৃত্যুসহ রিং বাণিজ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ নেওয়া’র অভিযোগ ওঠায় রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমানকে অন্যত্র বদলি বা পদায়ন করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সহকর্মীরা।
হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হরিপদ সরকার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রবীন্দ্র নাথ বর্মন, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাহিদ, সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসানুল ইসলাম, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. আশেকুর রহমান, এবং সহকারী রেজিস্ট্রার ডা মো. আব্দুল আলীম সরকারসহ ১১ জন চিকিৎসক এতে স্বাক্ষর করেন।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান কর্তৃক হার্টের রক্তনালীতে রিং পরানোর অনিয়ম নিয়ে ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লিখিত অভিযোগ করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রমেক হাসপাতাল কর্তৃক গঠিত পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি তদন্তও করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জেনেছি যে, ডা. মো. মাহবুবুর রহমান অভিযোগকারীদেরকে নানা রকম ভয়ভীতি ও অর্থনৈতিক প্রলোভন দেখিয়ে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করে আসছেন।
চিঠিতেও চিকিৎসকগণ আরও বলেন, ডা. মো. মাহবুবুর রহমান রমেক হাসপাতালের ক্যাথল্যাবের নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনিয়ম করেছেন। ডাক্তার হিসেবে রিং বিক্রির নিয়ম না থাকলেও তিনি নিজেই রোগীদের কাছে উচ্চমূল্যে রিং বিক্রি করেছেন। বিষয়টিতে কার্ডিওলজি বিভাগে কর্মরত আমরা সকলেই অত্যন্ত বিব্রত এবং প্রতিনিয়ত রোগীদের এবং চিকিৎসক সমাজের কাছ থেকে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য ও অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছি। অনেকেই প্রায়ই আমাদেরকে প্রশ্ন করেন- তিনি কি আবারও এই বিভাগে ফিরে আসবেন এবং একই ধরনের কার্যক্রম করবেন। আমরা আমাদের অন্যান্য সহকর্মী চিকিৎসক এবং উদ্বিগ্ন রোগীদের এই ধরনের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারি না।
এমতাবস্থায় ডা. মো. মাহবুবুর রহমান এ বিভাগে কর্মরত থাকলে তার অনিয়মের পুনরাবৃত্তি এবং রোগীদের প্রতিবাদের আশঙ্কাসহ বর্তমানে বিরাজমান সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে। বিধায় এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে ওই চিকিৎসগণ চিঠিতে উল্লেখ করেন। তারা চিঠির মাধ্যমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে রোগীদের সুচিকিৎসা ও কাজের পরিবেশ রক্ষার্থে অনতিবিলম্বে তাকে অন্যত্র পদায়ন/বদলি করার অনুরোধ জানান।
তবে এসব অভিযোগ শুরু থেকে অস্বীকার করে আসছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ডা. মাহবুবুর রহমানের ‘রিং বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঢাকা পোস্ট। এরপর তাকে নিয়ে ঢাকা পোস্ট একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার ভিত্তিতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
সূএ : ঢাকা পোস্ট