চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশে উন্নয়নে এগিয়ে যাবে রংপুর অঞ্চল, এমনটাই দাবি শহীদ আবু সাঈদের বিভাগের মানুষদের। বিগত ১৬ বছরে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন এবং বরাদ্দ থেকে বরাবরই বঞ্চিত ছিল এই অঞ্চল। এজন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এ অঞ্চলের দারিদ্রতা বিমোচনে থমকে থাকা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও শিল্পায়নে গুরুত্বারোপ করার জোর দাবি উঠেছে।
পিছিয়ে পড়া রংপুরের মানুষ বলছেন, বরাদ্দ বৈষম্যের শিকার হয়ে রংপুর বিভাগে শুধু দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বাড়েনি, বেড়েছে কর্মহীন মানুষও। দীর্ঘদিনেও হয়নি কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়ন। ফলে কৃষির ওপর নির্ভর করে চলছে উত্তরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি। বিগত সরকার চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিলেও আটকে আছে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম। অথচ একই সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ।
নীলফামারীতে একমাত্র উত্তরা ইপিজেড ছাড়া দীর্ঘ সময়ে রংপুর অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি ভারি কোনো শিল্প কলকারখানা। এখনও এই অঞ্চলের শিল্প আটকে আছে কিছু চালকল, পাট ও ক্ষুদ্র শিল্পে। ফলে বিভাগের ৭০ শতাংশ মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি অর্থনীতির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
জানা গেছে, দিনাজপুরে ৩০৮ একর জমির মধ্যে অধিগ্রহণ হয়েছে মাত্র ৮৭ একর। এছাড়া পঞ্চগড়ে ২৫০ একরের মধ্যে ১৮৭ একর ও নীলফামারীতে ১০৬ একর জমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজার কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ১৪৯ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা পাড়ে ২৫৪ দশমিক ২৩ একর জমির ওপর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০২৪ সালে কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের হয়বৎ খাঁ মৌজায় ২৫৪ একর খাস জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল বিগত সরকার। এজন্য জমি নির্বাচনের কাজ চূড়ান্ত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ সংক্রান্ত পত্র প্রেরণ করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হোঁচট খেয়ে থমকে যায় লালফিতায় বাঁধা অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বপ্ন।
শিল্প উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, বিগত সরকার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও রংপুর অঞ্চলে সেই দৃশ্য প্রতিফলিত হয়নি। এই অঞ্চলে চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেলেও আটকে আছে ভূমি অধিগ্রহণেই। হাসিনা সরকার রংপুরের মানুষের প্রতি ন্যায্যতা দেখাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
তারা বলছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে রংপুর বিভাগের মানুষকে শুধু আশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখা ছাড়া কিছুই হয়নি। অথচ একই সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে চাঙ্গা করেছে বিগত সরকার। এই বৈষম্য দূর করার জন্য বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে কাজ করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে যাতে আবু সাঈদের এই বিভাগ আর পিছিয়ে না থাকে, বৈষম্যের ফাঁদে না পড়ে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, সম্ভাবনা থাকার পরও বিগত সরকারের বৈষম্য নীতি প্রতিফলিত হয়েছে এই অঞ্চলে। বর্তমান সরকারকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ তাদের।
রংপুরের শ্রেষ্ঠ করদাতা ও ব্যবসায়ী নেতা তানবীর হোসেন আশরাফী বলেন, গত ১৬ বছরে বিভাগীয় নগরী হিসেবে রংপুরে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি। বাজেটগুলোতে রংপুরের প্রতি যে বৈষম্য করা হয়েছে, তা ছিল চরম অবহেলার সামিল। আমরা ভেবেছিলাম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে রংপুর বিভাগ বদলে যাবে। কিন্তু বাস্তবতায় তা হয়ে ওঠেনি, বরং উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ মিললেও বিভিন্ন জটিলতা দেখিয়ে কাজ হয়নি। এখন যদি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রংপুরের প্রতি সুনজর দেয় তাহলে বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে।
রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আকবর হোসেন জানান, রংপুরে অর্থনৈতিক জোন স্থাপন হলে এখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্র হবে প্রসারিত। সর্বোপরি এ অঞ্চলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। আর উদ্যোক্তা সৃষ্টি হলে বাড়বে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার বেকার যুবকদের।
দিনাজপুর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, গত সরকারের আমলে মন্ত্রী-এমপিরা উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু ফিতা কাটার মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল।
পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান খান বলেন, উত্তরাঞ্চলের কৃষি পণ্যের প্রসারে এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই অর্থনৈতিক অঞ্চল দ্রুত গড়ে তোলা দরকার।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ২৫০ একর জমির মধ্যে ১৮৫ একর সরকারি খাস জমি। বাকি ৬৫ একর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি। যেগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সরকারের নিয়মানুযায়ী। এই অর্থ সরকারের কাছ থেকে পাওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে শিল্পায়নে এগিয়ে নিতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য হয়েছে, তার শিকার হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। রংপুরের গঙ্গাচড়া এবং কাউনিয়াতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য বিগত সরকার স্বপ্ন দেখিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা অধরা ছিল। অজ্ঞাত কারণে এই অঞ্চলের মানুষ সুষম উন্নয়ন, বাজেটে কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ এবং ঘোষিত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সাফুদ্দীন খালেদ বলেন, উত্তরাঞ্চলের মানুষ বেশিরভাগ কৃষি নির্ভর। এখানে ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকাটা জরুরি।
সূএ : ঢাকা পোস্ট